আলহামদুলিল্লাহ! সকল প্রসংশা বিশ্বজগতের অধিপতি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার।
ইমাম বুখারী ট্রাস্টের আয়োজনে “আধুনিক পরিবারের সংকট: ইসলামী সমাধান” প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করার সুযোগ পেয়েছি। প্রোগ্রামটি অনলাইনে অনুষ্ঠিত হয় এবং আলোচক হিসাবে ছিলেন:
প্রোগ্রামটির শুরুতে অধ্যাপক ডক্টর মুহাম্মদ মানজুরে ইলাহি কুরআন এবং সুন্নাহর আলোকে পরিবারের উৎপত্তি এবং প্রকৃতি নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করেন। পরবর্তীতে শিবলী মেহদি ভাইয়া পরিবারের বিভিন্ন সমস্যা, কারণ এবং সমাধান নিয়ে আলোচনা করেন। নিচে সংক্ষিপ্ত আকারে আলোচনার কিছু অংশ আমার নিজের ভাষায় সংযুক্ত করছি।

প্রথম মানুষ থেকেই পরিবার শুরু হয়েছে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা আদম (আ:) এবং হাওয়া (আ:) কে সৃষ্টি করেছেন এবং বৈবাহিক সম্পর্কের মাধ্যমে তাদেরকে একটি পরিবারে রূপ দিয়েছেন। পরবর্তীতে আল্লাহ প্রদত্ত মাধ্যমেই মানবজাতির সৃষ্টি হয়েছে। পরিবার গঠনের একমাত্র উপায় বিবাহ।
মানুষ হিসাবে আমাদের নিজেদের দুর্বলতার জন্যই আমাদের পরিবারে বিভিন্ন সংকট তৈরি হয়। ঠিক একই ভাবে আমাদের কর্মক্ষেত্রেও বিভিন্ন সংকট তৈরি হয়।
যখন আমরা পরিবারে নানান সংকটের মুখোমুখি হই, তখন এটা ভেবে হতাশ হওয়া যাবে না, যে শুধু আমাকেই এমন পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যেতে হচ্ছে। কারণ সবার পরিবারেই সংকট থাকতে পারে। এমনকি আমরা কুরআন এবং সুন্নাহ থেকে জানতে পারি যে নবী এবং রাসূল (সা:) দের পরিবারেও বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সংকট দেখা দিয়েছে। এটা জীবনেরই অংশ। এটার একমাত্র সমাধান হলো আল্লাহ এবং তার রাসূলের (সা:) গাইডলাইন।
পরিবার একটি গাছের মতো। একটি গাছকে সুস্থ, সুন্দর করে গড়ে তোলার জন্য যেমন পরিচর্যা করতে হয়, ঠিক একইভাবে পরিবারকেও পরিচর্যা করতে হয়।
পরিবারে কেন সংকট তৈরি হয়
যেসব কারণে পরিবারে সংকট তৈরি হয়, নিচে এমন কিছু বিষয় তুলে ধরা হলো:
আমরা ছোট বড় নানা কারণে অতিরিক্ত রাগ করি
আল্লাহ আমাদের রাগ করতে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেছেন রাগ না করলে আমাদের জন্য জান্নাত আছে। কোনও কারণে রাগ হয়ে গেলেও আমাদেরকে ধৈর্য্য ধারণ করতে হবে। যদি কোনও কারণে রাগ তৈরি হয়েও যায়, তাহলে সাথে সাথে কিছু বলা বা করা যাবে না — মাত্র ৮ থেকে ১০ সেকেন্ড নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারলে রাগ কমে যায়। যেসব হরমোনের প্রভাবে রাগ আসে সেসব দ্রুত প্রশমিত হয়ে যায়।
তারপরও কিছু পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। যেমন দাড়িয়ে থাকলে বসে পড়া। বসে থাকলে শুয়ে পড়া। অথবা অজু করা। অথবা জায়গা ত্যাগ করা।
আমরা পরিবারের সাথে কোমল ভাষায় কথা বলি না
পরিবারের সাথে কোমল ভাষায় কথা বলতে হবে। হাদিসে আমাদেরকে সহজ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং কঠিন করতে নিষেধ করা হয়েছে। আমরা পরিবারের বাইরের মানুষের সাথে যেভাবে কোমল স্বরে কোথা বলি, পরিবারের মানুষদের সাথেও একই ভাবে কথা বলতে হবে।
আমরা ক্ষমা করি না
আমরা অন্যদের ক্ষমা করলে আল্লাহ আমাদের ক্ষমা করবেন। ছোট বড় নানা বিষয়ে মনোমালিন্য তৈরি হলে সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে ক্ষমা করার। এবং এর বিনিময়ে আল্লাহর কাছে সর্বোচ্চ পুরস্কারের আশা করতে হবে।
সোশ্যাল মিডিয়ার কাছে পরামর্শ নেই
অনেকেই নিজেদের ব্যক্তিগত বিষয় বা সমস্যাগুলো সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করে পরামর্শ চায়। কিন্তু পরামর্শ নিতে হয় জ্ঞানীদের নিকট থেকে। যে বিষয়ে আমরা সমস্যায় আছি সে বিষয়ে জ্ঞানী এবং আস্থাভাজন কোনও ব্যক্তির নিকট গিয়ে পরামর্শ চাইতে হবে।
ভালোবাসা ও দয়া করা
হাদিসে আছে, যে দয়া করে না তাকে দয়া করা হয় না। পরিবারের সকলের প্রতি ভালবাসা ও দয়া রাখতে হবে।
আমরা জুলুম করি
অথচ আল্লাহ নিজের উপর জুলুম করা হারাম করে নিয়েছেন, আমাদেরকেও জুলুম করতে নিষেধ করেছেন।
নারী পুরুষের বৈশিষ্ঠ্য খেয়াল করি না
সৃষ্টিগত ভাবেই নারী পুরুষ আলাদা। তাদের প্রকৃতি, কাজ, দায়িত্ব আলাদা। আমাদের এটা খেয়াল রাখতে হবে। পুরুষের সাথে যেভাবে মিশতে হবে নারীদের সাথে সেভাবে মেশা যাবে না।স্ত্রীরা কোমল স্বভাবের হওয়ায় তাদের সাথে কমল আচরণ করতে হবে।
আমরা পরিবারের জন্য দুআ করি না
পরিবারের জন্য, স্পাউসদের জন্য প্রচুর দুআ করতে হবে। সালাতে দুআ করতে হবে। কোনও কারণে স্পাউস কোনও ভুল করলে তার জন্য দুআ করতে হবে যেনো সে সংশোধন হয়ে যায়। নিজ ভাষায় আল্লাহর কাছে দুআ করা যাবে।
আমরা তাকওয়া অবলম্বন করি না
প্রত্যেক কথা ও কাজে তাকওয়া অবলম্বন করতে হবে।

একটি বিষয় খেয়াল করুন
আমরা আমাদের কর্ম ক্ষেত্রে পুরোপুরিভাবে ইসলাম পালন করার সুযোগ নাও পেতে পারি। কিন্তু আমাদের পরিবারে আমরা চাইলেই পুরোপুরিভাবে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে পারি।
ঢাকায় প্রতি ৪০ মিনিটে ১টি তালাক হয় (২০২৩)

তালাকের কিছু কারণ

কর্মজীবন ও পারিবারিক সময়ের ভারসাম্যহীনতা

কাজের জন্য আমরা পরিবারকে পর্যাপ্ত সময় দিতে পারি না। সেক্ষেত্রে কাজের বিরতিতে কল দেওয়া, টেক্সট করে খোঁজ নেওয়া, বা একটা সুন্দর ইমোজি দেওয়া যেতেই পারে। অফিস শেষে বাসায় ফিরে নিজেদের সারাদিনের ঘটনাগুলো শেয়ার করতে পারি।
আমরা যারা পরিবার থেকে দূরে থাকি, সম্ভব হলে স্পাউজকে সাথে রাখার চেষ্টা করতে পারি। যারা প্রবাসে থাকি, তার বেশি বেশি দুআ করতে পারি।
সাংস্কৃতিক চাপ বনাম ইসলামী মূল্যবোধ

সোশ্যাল মিডিয়ার অতিরিক্ত ব্যবহার

অনলাইন লাইভ শপিং আসক্তি

অপ্রয়োজনীও কেনাকাটা থেকে বিরত থাকতে হবে।
অবাধ মেলামেশা (ফ্রি মিক্সিং)

জীবিকার প্রয়োজনে আমাদেরকে কাজ করতে হয়। কিন্তু কাজের পরিবেশ সবসময় সুন্দর ইসলামিক পরিবেশ নাও হতে পারে। সেক্ষেত্রে নিচের বিষয়গুলো খেয়াল রাখা যেতে পারে:
- সবসময় চোখ অবনত রাখা
- অপ্রয়োজনে কথাবার্তা বা গসিপ এড়িয়ে চলা
- প্রয়োজনিয় কোথা বা কাজ সম্ভব হলে টেক্সট মেসেজের মাধ্যমে করা
- পর্দা মেনে চলা
- আল্লাহকে ভয় করা
কেনো স্পাউজকে ক্রমান্বয়ে ভালো লাগে না?

সোশ্যাল মিডিয়া আমাদের মধ্যে কিছু ভুল ধারণা তৈরি করে। প্রত্যেকেই তাদের জীবনের সাফল্যের দিকগুলো, আনন্দের দিকগুলো শেয়ার করে। কিন্তু ব্যর্থতা, কষ্টের বিষয়গুলো শেয়ার হয় খুব কম। অন্যের চাকচিক্যময় স্ট্যাটাস দেখে মনে হতে পারে যে অন্য মানুষের স্পাউস কত রোমান্টিক কিন্তু আমার স্পাউস তো এত রোমান্টিক নয়! ওদের স্পাউস ওদের এত কিছু গিফট দেয়, আমার স্পাউসতো আমার জন্য এত কিছু করে না! এরপর নিজের পরিবারের উপর থেকে আগ্রহ কমতে থাকে। তাই আমাদেরকে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারে সাবধান হতে হবে।
কেউ যদি যথেষ্ট ম্যাচিওর হয় এবং নিজেকে সোশ্যাল মিডিয়ার এই খারাপদিকগুলো থেকে নিরাপদ মনে করে, তাহলে প্রয়োজন পূরণে সে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করতে পারে। অন্যথা সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার না করাই উত্তম।
বোনদের ক্যারিয়ার বনাম পরিবার

আল্লাহ আমাদেরকে আমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী দায়িত্ব দিয়েছেন। তিনি আমাদের উপর জুলুম করেন নি। চাকরি করার পূর্বে নিশ্চিত করতে হবে পরিবারের হক আদায় করতে হবে। যথাসম্ভব পর্দা অবলম্বন করতে হবে। হালাল রিজক অন্বেষণ করতে হবে।
সকাল বেলার কৌশল

আলোচনার শেষের দিকে শিবলী ভাইয়া একটি কৌশল শেয়ার করেছেন। কিভাবে খুব দ্রুত ঝগড়া মিটিয়ে ফেলা যাবে। কৌশলটি হলো: প্রতিদিন সকালে অফিসে যাওয়ার সময় স্ত্রী, সন্তানদেরকে কপালে চুমু খাওয়া।
এই একটি ছোট কাজ প্রতিদিন করলে ঝগড়া বিবাদ মিটে যাবে ইনশাআল্লাহ এবং পরিবারের সাথে সুন্দর সম্পর্ক তৈরি হবে। রাতে কোনও কারণে ঝগড়া বিবাদ সৃষ্টি হলে সকালের এই সুন্দর মুহূর্তটি দুজনের মধ্যে সব মিটমাট করে দিতে পারে।
যদি স্ত্রী কাছে না আসতে চায় তাহলে ৩ কুল সূরা পরে ফু দেওয়া যেতে পারে। এই ক্ষেত্রে রাগ থাকলেও স্ত্রী কাছে আসবে।
সমাপ্তি
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা যেন আমাদেরকে উল্লিখিত বিষয়গুলোর উপর আমল করার তৌফিক দান করেন। আমাদের পরিবার জীবনে সুখ সমৃদ্ধি এবং বারাকাহ দান করেন। আমিন।

Leave a Reply